” একটা ডানা-মেলা পাখি… উড়াল দেয় আকাশের এই কোণা থেকে ঐ কোণায়…খুঁজে ফিরে একটা ডাল, বসবার জন্য…একটা ডাল ডেকে নিয়ে তারে বসায়, আবার সেই ডালই কাঁটা বেঁধায় বুকে…পাখি ক্ষত-বিক্ষত হয়, রক্তাক্ত হয়…তবু সেই ডালেই সে বসে থাকতে চায়…হোক সে ডালে কাঁটা, হোক সে ক্ষত-বিক্ষত, হোক সে রক্তাক্ত…উড়তে উড়তে যে সে ক্লান্ত…এবার সে একটু বিশ্রাম চায়, তাই বসবেই সে এই ডালে…প্রাণ মাত্রই সব সয়ে যায়, ব্যথাও সয়ে যাবে…” …
মাঝে মাঝেই ফেসবুকে এমন কিছু কথা স্ট্যাটাস বক্সটায় লেখা হয়, যেগুলো পড়ে নিজের কাছেই বেশ ভালো লাগে … এটাও এরকম একটা লেখা … গতবছর এইদিনে লিখেছিলাম … অনেক মন খারাপ করে লেখা ছিলো … ‘সে’ তার ফেসবুকের স্ট্যাটাসে লিখেছিলো ‘ ইট ইজ বেটার টু বি অ্যালোন দ্যান বি উইথ সামওয়ান হু মেক ইউ ফিল অ্যালোন’ … কথাটা আমাকে উদ্দেশ্য করেই ছিলো কি না আমি নিশ্চিত না … তবে সেদিন সন্ধ্যায় তার সাথে আমার সাজগোজ করে দেখা করা সংক্রান্ত বিষয়ের সূত্র ধরে অন্য অনেক কিছু নিয়ে বেশ যুক্তি-তর্ক হয়েছিলো … ‘আমার সাথে দেখা করতে বের হলেই তোমার সাজগোজ করার সুযোগ হয় না’ এই টাইপের অভিমানী কথাবার্তা সে সবসময়ই বলতো … আর আমার যুক্তি ছিলো যে সাজগোজ বিষয়টা আমার পছন্দ না … নেহায়েত চোখে কাজল দেই, এটুকুই … কেন আমার কান ফোঁড়ানো না, কেন নাক ফোঁড়ানো না, কেন আমি লিপস্টিক দেই না , কেন চুল বড় নয়, কেন ‘ মেয়েদের মতো’ থাকি না … এসব নিয়ে তার সাথে প্রথম দিকে আমার বেশ যুক্তির আদান-প্রদান হতো … তাকে আমি সবসময়ই এটা বোঝাতে ব্যর্থ হতাম যে আমি ওই টাইপের মেয়ে না যে একটা ছেলেকে দেখানোর জন্য পুতুল সেজে থাকবো … আমার সাথে যদি কেউ থাকে তো আমি যা তা পছন্দ করেই থাকবে … এটা হতে হবে, ওটা হতে হবে টাইপ কোনো বাধ্যবাধকতা কেন থাকবে? ! …
‘তার’ সাথে মাঝে মাঝেই আমার এরকম ভার্চুয়াল ভাবের আদান-প্রদান হতো … অনেক কথাই তাকে কখনো সরাসরি বলা হতো না, কিন্তু এমনভাবে কিছু লিখতাম স্ট্যাটাস বক্সে, যেটা আসলে তাকে নিয়ে বা তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হতো … সেও মাঝে মাঝে সেরকম করতো … শেষের দিকে তার ফেসবুকের পোস্ট আর ইন্সটাগ্রামের পোস্টগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করেই ছিলো যেখানে সে বলতে চাইতো যে আমি তার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছি …
‘আই লেট ইউ ইন, আই ফাকিং লেট ইউ ইন, বাট ইউ কমপ্লিটলি ডেস্ট্রয়েড মি’ ! … ইন্সটাগ্রামে এই পোস্টটাই লাস্ট দেখেছিলাম … তারপর তো ব্লকডই হয়ে গেলাম … কথাটা মাথার মধ্যে এমনভাবে গেঁথে আছে! কোনোভাবেই বের করতে পারি না! … আর কথাটা ঠিক যে মুহুর্তগুলায় একটু বেশি বেশি মাথায় খেলা করে তখনকার অনুভূতিটা কেমন একটা রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা মেশানো একটা অনুভূতি হয়! … এতকিছুর পর ওর কাছে মনে হয় আমি ওর জীবন ধ্বংস করে দিয়েছি, আর আমার সাথে যা কিছু, যেসব শারীরিক আর মানসিক কন্সিকুয়েন্স আমি বয়ে বেড়াচ্ছি এবং সারাজীবন বেড়াবো, তার প্রেক্ষিতে আমি তো ওকে মুখ খারাপ করে একটা গালি পর্যন্ত দিতে পারি না! …
যাই হোক, প্রসঙ্গ সেটা না … এমনকি সে-ও না…
ফেসবুক স্ট্যাটাস নিয়ে কথা শুরু করেছিলাম … ফেসবুকের প্রসঙ্গটা আসলো অবশ্য টাইমহপের কারণে …
টাইমহপ ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম ৪/৫ বছর আগে কি জানি কি প্রসঙ্গে লিখেছিলাম ‘ বেবি, ক্যান আই হোল্ড ইউ টুনাইট?’ … বয়জোনের গান … আমার অনেক পছন্দের গান … সেটা দেখে মনে হলো গানটা শুনি … সেটা শুনতে শুনতে একের পর এক পুরনো অনেক গান শুনেই যাচ্ছি … ৮০ দশক, ৯০ দশকের গানগুলো এখনো শুনতে কত ভালো লাগে! … সেই যে আগে ক্লাস সেভেন কি এইটে যখন পড়ি, তখন প্রতিদিন সকালের রুটিন ছিলো সকাল ৬ঃ৩০-এ ঘুম থেকে উঠে টিভি ছেড়ে দিয়ে এমটিভি ক্ল্যাসিক দেখতাম … আশি- নব্বই দশকের সব হিট গানগুলো শুনতে পারতাম সেখানে … যেসব গান শুনে শুনে বড় হওয়া, সেই গানগুলো এখনো সমান আবেগের সাথেই ভালো লাগে …
কার্পেন্টারের ‘ইয়েস্টারডে ওয়ান্স মোর’ -এর মতোই অবস্থা … ‘ দোজ ওল্ড মেলোডিজ, স্টিল সাউন্ড সো গুড টু মি/ ইট ক্যান ইভেন মেক মি ক্রাই/ জাস্ট লাইক বিফোর/ ইয়েস্টারডে ওয়ান্স মোর … ‘
ইয়েস্টারডে ওয়ান্স মোর অবশ্য আরেকটা নস্টালজিয়া … সেই যে আমরা ‘ফ্রেন্ডস ব্রুক’ মিলে ক্লাস এইটের ক্লাস পার্টিতে এই গানটা গেয়েছিলাম … এখনো এই গানটা শুনলে আমার সেই দিনটার কথাই মনে পড়ে … ‘ এভরি শা লা লা লা, এভরি ও ও ওহ ওহ স্টিল শাইন!’ …
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে শরীরের যেই অবস্থা হচ্ছে দিন দিন, তাতে মনে হয় খুব শিগগিরই আমাকে পুরোপুরি গৃহবন্দী হয়ে যেতে হবে … অল্পতেই প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে যাই ইদানীং, আর পেটের ব্যথা, কোমরের ব্যথা তো আছেই … প্রতিটা দিন বাসায় ফিরেই আর কোনদিকে না তাকিয়ে অন্তত ঘন্টাখানেক আমাকে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকতে হয়, তারপর প্রচণ্ড অরুচি নিয়ে অল্প ভাত খাই, তারপর একটু ফেসবুক, তারপর দিনযাপন লেখা এগুলো করে ঘুম … ঘুম থেকে উঠি অনেকটাই ফ্রেশভাবে… কিন্তু দিনের শুরু করতে করতেই আবারো সকল প্রকার অস্বস্তি ফিরে আসে … আর সারাটা দিন সেই অস্বস্তিকে টেনে বেড়াই …
শেষপর্যন্ত শরীরের কাছে পরাজয় মেনে জীবনযাপন করতে হবে, এটা ভাবতেই কেমন জানি জিদ লাগে!
হাসিও পায়! … এটাই জীবন! …
জীবন বিষয়টা কেন যে এত লম্বা! ৪০/৫০/৬০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে গিয়ে কতরকমের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয় আমাদের! …
একসময় আমার দৃঢ় ইচ্ছা ছিলো, ৪০ বছর হয়ে যাবার পর স্বেচ্ছামৃত্যু’র পথ বেছে নেবো! … কারণ আমার কাছে মনেই হয় যে ৪০ বছরের পর থেকে মানুষ আসলে একরকমের একটা জীবনকেই সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় … আমাকে দিয়ে আদৌ সেটা হবে না! … আর যেরকমভাবে এখন চলি, সেরকম অনিশ্চিত অভিজ্ঞতার জীবন আসলে অনেক লম্বা সময়ের জন্য হলে সেটাও বিরক্তিকর হয়ে যাবে … সে কারণেই আমার সিদ্ধান্তটা ছিলো এমন যে ৪০ হবার সাথে সাথেই দুনিয়া থেকে বিদায় … আপাতত সেই ইচ্ছাটা নিয়ে ভাবি না … কিন্তু ৪০ বছরের কাছাকাছি গিয়ে নিশ্চয়ই আবার ভাববো! …
আজকে শো ছিলো আমাদের … ‘মায়ের মুখ’ … প্রডাকশন ম্যানেজার হবার কল্যাণে নাটকটার সাথে একধরনের ব্যস্ততার সম্পর্ক আছে … নাটকের গল্পের সাথেও সম্পর্ক কম নয়! … একটা সময় একটা ওভারঅল চিন্তাগত সম্পর্ক ছিলো … আর এখন মনে হয়, আমার জীবনটা ওই যে রুথের মতো হইতেই পারতো! … রুথ চরিত্রটার সাথে এখন আমার দীর্ঘশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে … আমার জীবনটা না নওমি’র মতো হয়ে যায় সেই শঙ্কা তৈরি হয়েছে … তবুও ভালো মায়ের মুখ নাটকের পুরোটা সময় আমার শ্বাস ফেলার অবকাশটাই অল্প থাকে … না হলে হয়তো শুধু দীর্ঘশ্বাস না, চোখের পানিরও সম্পর্ক তৈরি হতো … এই নাটকের মঞ্চায়নের কাজে ভয়াবহ ব্যস্ততা আমাকে দুঃখবিলাসের অবকাশ দেয় না মোটেই … এটাই অনেক ভালো একটা দিক …
ভয়ঙ্কর রকমের ব্যস্ত থাকতে হবে … ভয়াবহ লেভেলের ব্যস্ত … তাহলে হয়তো সবকিছু ভুলে থাকতে না পারলেও সেগুলো নিয়ে ভেবে ভেবে কষ্ট পাওয়ার সুযোগটা পাওয়া যাবে না … একা থাকার সময়গুলোই এখন আমার কাছে অনেক আতঙ্কের … কারণ একাকীত্ব আমাকে চিন্তা করতে বাধ্য করে … আর চিন্তার সূত্রগুলো কীভাবে কীভাবে জানি ঐ একটা পয়েন্টে গিয়েই প্রচণ্ড পেঁচিয়ে যায় …
কিন্তু সবসময় কি আর দলবলের সাথে থাকা যায়! …
ফুয়াদ মাঝে মাঝে শাহবাগের পথে হাঁটতে হাঁটতে বলে, ‘ আমরা সবাই যদি একসাথে থাকতে পারতাম, তাইলে কি ভালো হইতো!’ … ওর এই কথাটা শুনলে আমিও মনে মনে একই জিনিস ভাবি … সত্যিই, সবাই যদি একসাথেই থাকা যেতো, তাহলে কতো ভালো হতো! … মন খারাপ করার সময়ই পেতাম না! …
গতকালকে গ্রুপ থেকে বের হয়ে দলবেঁধে শাহবাগে যাচ্ছি হেঁটে হেঁটে, পথে জার্নাল ভাইয়ের সাথে দেখা … আমাকে দেখেই সে বলল, ‘রাত এগারোটা বাজে, এখন শাহবাগে কি? বাসায় যাস না কেন?’ … আমি বলতে চেয়েছিলাম ‘ বাড়ি যাবার সঙ্গী তো শাহবাগে যায়, তাই যাচ্ছি … ‘ কিন্তু সেটা না বলে বললাম, ‘ বাড়িঘরের সবাই তো এখানে, তাই যাচ্ছি!’ … কেমন জানি অটোমেটিক্যালিই মুখ দিয়ে এই কথাটাই বের হয়ে গেলো! … কথাটা বলে নিজের কাছেই বেশ অবাক লাগলো … আবেগের টানাপোড়েন এখন কতটা নির্ভর করে এই মানুষগুলোর ওপর! … প্রতিদিনের জীবনযাপনের অংশ হয়ে যাচ্ছে এখন এই মানুষগুলো …
জীবনযাপন … দিনযাপন … সময়যাপন …
সবকিছুই এখন ক্যামন আবেগের টানাপোড়েন …
ক্যামন একটা আঁকড়ে ধরা … লাস্ট রিসোর্টের মতো … ওইদিন কি একটা কথার প্রত্যুত্তরে এই মানুষগুলা প্রসঙ্গে এইরকমই একটা কথা সাদ্দামকে বলছিলাম শাহবাগে দাঁড়িয়ে … এখন প্রসঙ্গটা একদমই ভুলে গেছি … মনে করার চেষ্টাও করে লাভ নাই …
আজকের দিনযাপন এখানেই শেষ … আর পারছি না জেগে থাকতে …