আজকে ফেসবুক জুড়ে ভূমিকম্প সমাচার চলছে …
৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প কি কম কথা! …
ভূমিকম্প যখন হয় তখন আমি ল্যাব এইডে … পুরো দুই বোতল পানি খেয়ে পেট ফুলিয়ে ব্লাডারের প্রচণ্ড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি … আল্ট্রাসনোগ্রাফির জন্য আমার সিরিয়াল তখনো আরও দুইজন কি তিনজনের পরে … হঠাৎ টের পেলাম যে চেয়ারে বসে আছি সেটা কাঁপছে। প্রথম মনে হলো পেছনে বসা মোটাসোটা ভদ্রলোক মনে হয় পা নাড়াচ্ছেন বা কিছু, সে জন্য হয়তো কাঁপছে। তারপরেই মনে হলো চেয়ারটা তো আসলে ডানদিকে ক্রমাগত হেলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে! তখন মনে হলো আমারই বোধহয় ব্লাডারের প্রচণ্ড চাপের কারণে মাথা ঘোরাচ্ছে … মা- ও দেখি পাশের চেয়ার থেকে কেমন কেমন করে তাকায় আছে … ঠিক যে মুহুর্তে নিজেকে কনভিন্স করে ফেলছি যে আমার মাথা ঘোরাচ্ছে, তখনি মা বলে উঠলো, ‘ কি হচ্ছে? ভূমিকম্প নাকি?’ … সাথে সাথে রিফ্লেক্স এর মতো ব্রেন সিগনাল ট্রান্সমিট করে নিলো যে ‘ হ্যাঁ! তাই তো! এটা তো ভূমিকম্প!’ … ততক্ষণে প্রায় একই সময়েই সবাই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে এটা ভূমিকম্প … মোটামুটি একটা হুড়োহুড়ি লেগে গেলো মুহুর্তের মধ্যে … সবার উদ্দেশ্য নিচে নামবে … আমি আর মা-ও নামবো কি নামবো না করতে করতে একটু একটু করে আগাতে শুরু করলাম … ততক্ষণে অবশ্য কাঁপুনি থেমে গেছে … নিচে নেমে দেখলাম বেশিরভাগ মানুষই রাস্তায় বের হয়ে গেছে … মিনিট দশেক দাঁড়ানোর পর আবার সবাই ভেতরে যেতে শুরু করলো …
উপড়ে উঠে প্রথমেই সবার আলোচনা কে কি মনে করছিলো … বেশিরভাগ মানুষেরই প্রথম অনুভূতিটা ছিলো তাদের মাথা ঘোরাচ্ছে … হাসপাতাল বলেই হয়তো সবার অনুভূতিটা একরকম হয়ে গেছে! … তারপর সবার মনোযোগ চলে গেলো টেলিভিশনের খবরের আপডেটে … ৭ মাত্রার ভূমিকম্প! …
নেপালের কি অবস্থা! আমার প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গেছে নেপালের ছবিগুলা দেখে … নেপাল তো ঘুরে আসা দেশ … নিজের চোখে দেখা জায়গাগুলো এভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে ভাবতেই কেমন মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে … দরবার স্কয়ারের বেশ কিছু মন্দির ভেঙ্গে চুরমার … দরবার স্কয়ার! সত্যজিৎ রায়ের ‘যত কাণ্ড কাঠমুন্ডুতে’ পড়েই তো প্রথম দরবার স্কয়ারের বর্ণণা জেনেছিলাম … তারপর নেপাল গিয়ে নিজের চোখে সেই জায়গার সৌন্দর্য দেখে এসেছি, প্রাচীনত্ব অনুভব করে এসেছি … সেই দরবার স্কয়ারের ধ্বংসস্তুপের চেহারা দেখতে কি ভালো লাগবে? …
নেপালে বন্ধু আর পরিচিতজনেরা আছে … তাদের অবস্থাই বা কি! … সৌর, জুপিটার, পৃথ্বী, ওশো হোটেলের কিশোর ত্রিপথী, পোখারার ডবল ট্রি হোটেলের কালাধর দা, ড্রাইভার দিলীপ দা কিংবা আর যে মানুষগুলোর সাথে ঘুরতে ফিরতে পরিচয় হয়েছিলো … সেই মানুষগুলো কে ক্যামন অবস্থায় আছে? …
যতটুকু ভূগোল বুঝি, এরকম ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে দুই-একদিনের মধ্যেই আরেকটা মৃদু কম্পন হবার সম্ভাবনা থাকে … কারণ এইটা কেন্দ্র থেকে শুরু হয়ে বিস্তারের সময় এর কম্পনমাত্রা তো কমে নাই! … বাংলাদেশেও নাকি কম্পনের শক্তিমাত্রা ৭ এর কাছাকাছিই ছিলো, যদিও অনুভূতিটা ৩/৪ মাত্রার বেশি ছিলো না … তার মানে এটা হয়তো দুই ভূখণ্ডের মধ্যে আচমকা সংঘর্ষ ছিলো, এবং এখনো ওই হাজার হাজার ফুট নিচে এদের মধ্যে কাঁপাকাঁপি চলছে … এখন দ্বিতীয়বার এরকম জোরালো সংঘর্ষ না হলেই হয়! …
আমার কেন জানি মনে হয় যে এরকম প্রচণ্ড ভূমিকম্পের প্রভাব যদি বাংলাদেশেও পড়ে, তাহলে বিল্ডিং বা জনপদ ভেঙ্গেচুরে ধ্বংস হবে কম, বরং দেশের পুরো মধ্যভাগটাই ডেবে যাবে! হিমালয় পর্বতমালার প্রতিবেশী দেশ হিসেবে তো ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক অত্যাচার একটু কম-বেশি সহ্য করে যেতেই হবে বাংলাদেশকে ! তারওপর প্রায় তিনদিকে পাহাড় আর একদিকে সাগর! কোনো দিক দিয়েই তো রেহাই নাই! বাংলাদেশ -এর ভৌগোলিক অবস্থান আর ভূ-প্রকৃতি সাপেক্ষে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প দীর্ঘস্থায়ী হলে মাটির প্রচণ্ড কম্পন হবার কথা আর ওর্স্ট কেস সিনারিও হিসেবে বঙ্গোপসাগর থেকে একটা বড়সড় সুনামি হবার কথা কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিম অংশটা, মানে যেদিকে সুন্দরবন সেই অংশটা আলাদা হয়ে যাবার কথা … কিন্তু আমরা দেশের মাঝখানটাকে এমনভাবে এক্সপ্লয়েট করে ফেলেছি যে কিছু হলে আসলে সব চাপ এসে এখানেই আগে পড়ে! …
আজকেই তো ভূমিকম্পের সময় ভাবছিলাম যে এখন যদি এই কাঁপুনি না থেমে বরং আরও তীব্র হয় আর সবকিছু ভেঙ্গে পড়ে, তাহলে বাঁচার উপায় কি আদৌ আছে? …
আরেকটা জিনিস দেখে হাসিই পাচ্ছে … বাংলাদেশে যে দিন দিন মানুষের আয়োডিনের অভাব বেড়েই চলছে, আর সে জন্য যে বুদ্ধি খাটিয়ে চলার অনুশীলনটা কমে গিয়ে হুজুগে মেতে চলা বাঙ্গালিপনা বেড়েই চলছে, সেটার একটা প্রমাণ পাওয়া গেলো দলে দলে নেপাল আর্থকুয়েক-এর সেফটি চেকইন -এ নিজেকে ‘সেফ’ বলে মার্ক করা দেখে … ওই জিনিস করা হয়েছে নেপালে এখন যারা আছে তাদের জন্য, আর পাবলিক বাংলাদেশে বসে বসে নিজেকে সেফ মার্ক করছে! … তাদের কাছে মনে হচ্ছে হয়তো যে ভূমিকম্প যেহেতু বাংলাদেশেও টের পাওয়া গেছে, তার মানেই বাংলাদেশ ‘অ্যাফেক্টেড’ এরিয়ার আওতায় পড়ে! … বাঙ্গালির এই কালেক্টিভ বুদ্ধিগুলো যদি আরও বেশি যুক্তি খাটিয়ে হতো, তাহলে বাংলাদেশ এতদিনে সবদিকেই চরম উন্নতি করতো! … পুরাই ভেড়ার পাল হয়ে যাচ্ছে সবাই …
যাই হোক, ভূমিকম্প ছাড়াও আজকে সারাদিনে আরও কিছু কাজ হয়েছে … সকালে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করানো হলো … আজকে সন্ধ্যাতেই রিপোর্ট পাবার কথা … মা আর বের হয়নি, তাই রিপোর্ট আনা হয়নাই … আমি ভাবছিলাম যে রাতে বাসায় ফিরেই রিপোর্টের আফটার-ইফেক্ট টের পাবো … কিন্তু বাসায় ঢুকেই মা’র নির্বিকার চেহারা দেখে প্রথমে অবাক হলাম, তারপর ধারণা করলাম যে রিপোর্ট আনে নাই বোধহয় … জানলাম ঘটনা আসলেই তাই … যাক! আরেকটা রাতের জন্য হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেলো! …
আল্ট্রাসনোগ্রাফি করিয়ে দুপুরের দিকে মিরপুর গেছি … মিরপুরের বাসায় ইলেকট্রিক সুইচ লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে … এদের সুইচের ওপর আমার ভরসা কম, তাই নিজের ঘরটাতে অন্তত নিজে বুঝে-শুনে ভালো সুইচ দিতে চাই … সেকারণেই ওই সুইচগুলো নিজে কিনে দেবো বলে ঠিক করেছি … সেটার এস্টিমেটটা জেনে আসতেই আজকে অতদূর যাওয়া … লাইটের হোল্ডারগুলোও যে খুব পছন্দ হয়েছে তা না, কিন্তু সেগুলো তো তাও নিজেই পরে পাল্টে নেবার সুযোগ আছে, তাই সেগুলো নিয়ে আর কথা বললাম না … আর সেদিন অত তাড়া দিয়ে কিছু টাইলস কেনালো, অথচ গিয়ে দেখলাম সেই টাইলস-এর কাজ এখনো শেষ করে নাই … এইটা আমার বাপের বাড়ি না হয়ে নিজের বাড়ি হলে মনে হয় এতদিনে এদের সাথে আমার মারামারি লেগে যেতো! …
মিরপুরের বাসার কাজ সেরে টিয়ামের বাসায়ও একটু ঢুঁ মেরে আসলাম … ওই বাসায় গেলেই এখন মাস্টার্স কবে করবো, বিয়ে কবে করবো এইসব যাবতীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় … দুইদিন পর টিউমার -এর কথা জানলে যে আরও কি কি সব কথা শুনতে হবে! …
আজকে সন্ধ্যাটাও ক্যামন জানি ঢিলেঢালা মুডে কাটলো … গ্রুপে গিয়ে দেখি রানা আর ফুয়াদ ছাড়া কেউ নাই, বাকিরা সব নতুন দুইটা ব্যাচের পোলাপাইন। কেউ না থাকার সুযোগে নতুনদের নিয়েই আইস ব্রেকিং টাইপ কাজকর্ম হইলো … হালকার ওপর ঝাপসা rag দেয়া আর কি! … মজাই হলো … গ্রুপে মাঝে মাঝেই এরকম কাজকর্মহীন দিনগুলা ভালোই লাগে … আজকে অনেকদিন পর মনে হয় এমন একটা দিন আসলো যে গ্রুপে কারো যাবার তাগিদ নাই … একসাথে এতগুলা ইভেন্ট গেছে গত একমাসে যে এখন মনে হয় মাসের এই শেষ কয়েকটা দিন সবাই অলিখিতভাবেই ঐচ্ছিক ছুটি নিয়ে নেবে! …
আজকে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া দরকার … কালকে সকাল দশটার মধ্যে স্ক্লাস্টিকা থাকতে হবে ছবি তোলার জন্য … তারমানে ঘুম থেকেই উঠতে হবে সাতটার মধ্যে, আর বের হয়ে যেতে হবে সাড়ে ৮টার মধ্যে …
আমার তো শরীরের অস্বস্তির জন্য ঘুমই আসে না … সকাল সকাল ক্যামনে উঠবো কে জানে! …